Magic Lanthon

               

কাজী মামুন হায়দার

প্রকাশিত ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

বৃহন্নলা : বাবা-মুসোলিনির দেশে একটি চলচ্চিত্রের মৃত্যু ও নির্মাতা-মুরাদের বুজরুকি

কাজী মামুন হায়দার

১.

পত্রিকায় লেখা পড়েই মূলত আগ্রহী হয়েছিলাম বৃহন্নলা দেখতে। বৃহন্নলা মুক্তি পায় ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪। রাজশাহীর উপহার ‘সিনেমা’য় বৃহন্নলা প্রথম দেখার সুযোগ হয় ২২ সেপ্টেম্বর। প্রথম দেখার সুযোগ—এ কারণে বলছি যে, এর পরও বৃহন্নলা আরো দুইবার দেখি একই প্রেক্ষাগৃহে, একই সপ্তাহে। প্রথম দিন রাত ৯—১২টার শো দেখি, সবমিলে প্রেক্ষাগৃহে দর্শক ছিলো ১৫ জন।

একদিন পর ২৪ সেপ্টেম্বর আবার ৯—১২টার শো-এ যাই বৃহন্নলা দেখতে। এই দিন একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। চলচ্চিত্র শুরুর আধা ঘণ্টা পর প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষ জানায়, আকাঙ্ক্ষিত দর্শক না হওয়ায় তারা শো বন্ধ করে দিচ্ছে। টিকিটের টাকা ফেরত দেওয়া হয়। সবমিলে ওই শো-এ দর্শক ছিলো শৌখিনে মোট সাত জন। এর মধ্যে আমরা একসঙ্গে ছিলাম চার জন। প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষকে বলা হলো, চলচ্চিত্রটি দেখা দরকার। ওনারা বললেন, ‘কাল আসেন, চালাবো।’

পরের দিন মানে ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল পৌনে তিনটায় হাজির হলাম প্রেক্ষাগৃহে। এই প্রেক্ষাগৃহে ওই দিন বৃহন্নলার শেষ দিন। গিয়ে দেখা গেলো ততোক্ষণে প্রেক্ষাগৃহের সামনের দেয়ালে নতুন চলচ্চিত্র তুই শুধু আমার-এর পোস্টার সাঁটা হয়ে গেছে। আমরাই সেদিন বৃহন্নলার প্রথম দর্শক, এরপর ধীরে ধীরে লোক আসতে থাকলো। শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়ালো তা হলো—শৌখিনে ১১ জন, সৌরভে তিন জন ও ড্রেস সার্কেলে ৩০ জন; সবমিলে ৪৪ জন দর্শক নিয়ে শেষ হলো বৃহন্নলার শেষ দিনের প্রথম শো।

তবে দর্শকের এ অবস্থা দেখে চলচ্চিত্র ভালো না খারাপ, এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো মনে হয় মোটেও ঠিক হবে না। কারণ পৃথিবীর কোনো দেশেই দর্শক দেখে চলচ্চিত্রের ভালো-মন্দ বিচার করা হয় না, এ দিয়ে যা বিচার হয় তা হলো ব্যবসা। তাই বৃহন্নলা নিয়ে এটা আন্দাজ করা যায় যে, ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ চলচ্চিত্র। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, এটা হয়তো বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাই ব্যবসা নিয়ে কথা বলার অবকাশ নেই, তবে নিঃসন্দেহে চলচ্চিত্রটি নিয়ে কথা বলার অবকাশ আছে। এই কথা বলার প্রয়োজনীয়তা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে চলচ্চিত্রটির সরকারি অনুদান প্রাপ্তির ফলে। যদিও সঙ্গে নির্মাতা নিজেই এবং একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রযোজনা সহায়তা রয়েছে। তার পরও বিষয় হিসেবে বৃহন্নলা নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করছি।

২.

বৃহন্নলার কাহিনি গড়ে উঠেছে গ্রামের একখণ্ড খাসজমিকে কেন্দ্র করে। পতিত ওই জমিতে একটি বৃহৎ বটগাছ আছে। সেই জমিতে স্থানীয় মসজিদ কমিটি বড়ো মসজিদ বানাতে চায়, আর মন্দির কমিটি বানাতে চায় মন্দির। কিন্তু ‘রহস্যময়’ গাছটির সংস্পর্শে এসে একটি ছাগল ও তিন জন মানুষ মারা যায়। এ নিয়ে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, প্রেম, দ্বন্দ্ব, মৃত্যুর সমাবেশ ঘটে।  

একটি ‘সৃজনশীল’ চলচ্চিত্র হিসেবে বৃহন্নলার গল্প নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। যদিও গল্পের শুরুর রহস্যের টান টান উত্তেজনা অল্প সময়ের মধ্যে মিইয়ে যায়। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার কারণ নেই, চলচ্চিত্রের কাহিনি হিসেবে বৃহন্নলা অসাধারণ।

মহাভারত অনুযায়ী, ১২ বছর বনবাস কাটিয়ে এক বছরের অজ্ঞাতবাসের সময় অর্জুন নপুংসক হিসেবে ‘বৃহন্নলা’ নাম ধারণ করেন। বৃহন্নলার প্রায়োগিক অর্থ ফলশূন্য। ২০১০-১১ অর্থবছরে সরকারি অনুদানে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে সেই ফলশূন্য রাজনীতি নিয়ে নির্মিত হয়েছে বৃহন্নলা। তবে শুরুতে এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, চলচ্চিত্র-বৃহন্নলায় নির্মাতা-মুরাদের যে রাজনীতি সেটা মোটেও ফলশূন্য নয়।

৩.

২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল ভোরে শাপলা চত্বর থেকে বিতাড়িত হয়েছিলো হেফাজতে ইসলাম। ঠিক একই সময় আরেকটি মঞ্চও ভাঙা হয়েছিলো, সেটা সেই ‘স্বপ্নে’র শাহবাগের। একদিকে শাপলা, অন্যদিকে শাহবাগ; মাঝখানে দাঁড়িয়ে থেকে গোঁফে তেল দিয়ে রাষ্ট্র জানিয়েছিলো তার শক্তির কথা।

শাহবাগ-শাপলা চত্বরের মতো বৃহন্নলাতেও রাষ্ট্র সফল। কারণ সব অপশক্তি, মত, পথ, চিন্তার বাইরে গিয়ে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র কিন্তু সেই বৃহৎ বৃক্ষের ছায়ায় জনকল্যাণ-রাষ্ট্রের উপাদান বিদ্যালয় গড়ে তুলতে, ‘অসৎ’ চিন্তার নাগরিককে ‘সৎ’ পথে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। ঘটনার শুরু হয় তখন, যখন গ্রামের মসজিদের ইমাম মুসল্লিদেরকে সেই খাসজমিতে আরেকটি বড়ো মসজিদ তৈরির প্রস্তাব করে, বিপরীতে খাসজমির বিশাল বৃক্ষ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে ‘দেবতা’ হয়ে ওঠে, চলতে থাকে পূজা-অর্চনা।

ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাও বসে থাকেনি, তারাও প্রমাণ করতে থাকে ওই ‘বৃক্ষ-দেবতা’র অসাড়ত্ব। একদিকে ‘দেবতা’র আবির্ভাব-অপমৃত্যু, অন্যদিকে ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণের তাগিদ। আর এর বাইরে দীর্ঘ সময় ধরে পরস্পর ভাগাভাগি করে বসবাস করা দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস-অনাস্থা তো আছেই। ইমাম-মুসল্লি-মসজিদ কমিটির সভাপতি আর মন্দির কমিটির সভাপতির বাইরের যে পক্ষ, তাদের অনিবার্য দায়িত্ব হয় রাষ্ট্রের সহায়তার! আর রাষ্ট্র যেখানে সফল হয়, সেখানে নিঃসন্দেহে এতদিনের যে সামাজিক সম্পর্ক তা ভয়ঙ্করভাবে তোপের মুখে পড়ে। আর এই তোপ এতো ভয়াবহ যে, স্বজন স্বজনের (এখানে স্বজন বলতে আমি একই ধর্ম, একই রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসীদের কথা বলছি) হাতে খুন হয়। এমনটাই হয়েছিলো বৃহন্নলাতে। শেষ পর্যন্ত সবকিছু ভেঙে স্কুলও হয়, কিন্তু মানুষ আর জেতে না। শাহবাগ-শাপলার মতো জিতে যায় সেই রাষ্ট্রই।

আর এভাবে জিতে যাওয়া রাষ্ট্রের চরিত্র কী হয় সেটা তো মুরাদের জানার কথা!  

৪.

মুসলমান নিয়ে চলতি ডিসকোর্সের এই সময়ে বৃহন্নলার আগমন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। চলতি জঙ্গি ডিসকোর্সে দাড়ি-টুপির মুসলমানের যে আগ্রাসী অবস্থান উঠে আসে, তার বিপরীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একই ধরনের উপস্থাপন আমাদের ভাবায়। আসলে ধর্মের নিজের একটা রাজত্ব করার ক্ষমতা, একটা প্রবণতা আছে—সে ইসলাম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কিংবা ইহুদি যারাই হোক না কেনো। এরা সুযোগ পেলেই প্রভুত্ব করেছে, যদিও বাবা-লাদেনের খাসলতের বদৌলতে গত দেড় দশকে এর সবশেষ দায় এখন কেবল ইসলামকেই নিতে হচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, এই ‘দুর্ভাগ্য’ ইসলামকে আরো কতোদিন বয়ে বেড়াতে হয়! ইসলাম/জঙ্গি নিয়ে যে ডিসকোর্স মাথায় খেলা করে তা থেকে বেরোনো দায়। তাইতো মসজিদের ইমামের মেকআপ-গেটআপ কেনো জানি লাদেনের সেই চিরচেনা কাঁচা-পাকা দাড়ি, পাগড়ির সঙ্গে মিলে যায়। দৃঢ় কণ্ঠে লাদেনের মতোই আঙুল তুলে বলতে শোনা যায়, গ্রামের খাসজমিতে মসজিদ নির্মাণের কথা।

আর যেদিন ইমাম মসজিদে বসে ঘোষণা দেন খাসজমির বটগাছ কেটে মসজিদ হবে, ঠিক সেই রাত থেকেই বটগাছে ছাগল-মানুষ মরতে থাকে! এই সঙ্কট আরো ঘনীভূত হয় যখন ধর্মের সঙ্গে মহাপ্রতাপ নিয়ে যোগ হয় রাষ্ট্র নিজে। যদিও আপাত মনে হয় রাষ্ট্র নিজে আসে না, কিন্তু রাষ্ট্রকে আনা হয়। রাষ্ট্র আসার জন্য প্রস্তুতই ছিলো, কেবল ডাকের অপেক্ষা।

আর এই ডাক দেওয়ার লোক স্বয়ং আরজ আলী। গ্রামের অন্যতম ‘প্রগতিশীল’, ‘সৎ’, বিজ্ঞানমনস্ক হোমিও চিকিৎসক। গ্রামসির সিভিল সোসাইটির সঙ্গে মিলে যায়; আরজ আলীরা প্রভুত্ব করে না, তবে প্রভুত্বকে সমর্থন করে; বৃহৎ পরিসরে অধিকাংশের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখে। অনেকটা আজকের টক-শো আর্টিস্ট কিংবা সংবাদপত্রের জনপ্রিয় কলাম লেখকদের মতোই। সে কারণে মালালা-কৈলাশের নোবেল প্রাপ্তি কিংবা পিয়াসের মরদেহ শহীদ মিনারে নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে এরা যতোটা মুখর থাকে, তার বিপরীতে খুলনায় এক রাতে ১৩ বনদস্যুর ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়া নিয়ে এদের ততোটাই অনাগ্রহ। একই কারণে এরা সব সমাধানের পথ খুঁজে পান সবশেষে রাষ্ট্রের লোক দ্বারা রাষ্ট্রের কাছেই।     

খাসজমি নিয়ে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব যখন চরমে তখন গ্রামের সবাইকে বোঝানোর দায়িত্ব পড়ে ডা. আরজের ওপর। আরজকে তখন শশী মাস্টারকে লক্ষ্য করে বলতে শোনা যায়, ‘মাস্টার, এরা তোমার ছাত্র না। ... তার চেয়ে সরকারকে বোঝানো সহজ।’ ফলে সরকারকে বোঝানোর জন্য আরজ পুলিশের কাছে হাজির হন। সমস্যা সমাধানের প্রশ্নে গ্রামবাসীর মনোভাব সম্পর্কে পুলিশকে আশ্বস্ত করে আরজ বলেন, ‘... তবে সরকারের লোকের ওপর তাদের (গ্রামবাসী) অনেক আস্থা।’

অবশ্যই সরকারের ওপর মানুষের ‘আস্থা’ আছে। শাহবাগ-শাপলা তোয়াক্কা না করা সরকার যখন গণতন্ত্র রক্ষার নামে বছরের পর বছর থাকতে চায়, তখন মুরাদের বৃহন্নলায় সরকারের ওপর সাধারণের বিশাল আস্থা তো দেখাতেই হয়! তবে মুরাদ যে ভারসাম্য আনার চেষ্টা একেবারে করেননি তা নয়। পুলিশকে ঘুষ নিতে দেখিয়েছেন। কিন্তু সেই ঘুষে যে কাজ হয় না তা-ও দেখিয়েছেন। কারণ আরজ আলী যেভাবে পাঁচ বছর চিঠি পাঠিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসক এনেছেন, ঠিক একইভাবে চিঠি দিয়ে সমস্যাসঙ্কুল সেই খাসজমিতে সরকারকে দিয়ে ডিক্রি জারি করিয়েছেন ডা. আবির। তবে এখানে দুই অবস্থার মধ্যে পার্থক্য আছে, আরজ আলীর পাঁচ বছর লাগলেও আবিরের কিন্তু বেশিদিন লাগেনি। হাজার হলেও সরকারে তো পরিবর্তন এসেছে!  

এখন প্রশ্ন, মুরাদ কি এটা বুঝেই করেন?

৫.

আবারও বলছি, এই আরজ আলী সেই আরজ আলী, যিনি ইমামের খুতবা শুনে সবার মতো চুপ না থেকে ‘বাখওয়াজ’, ‘বাখওয়াজ’ বলতে থাকেন। আবার একই আরজ আলী হোমিও যুগের শেষ ঘোষণা করে অসুস্থ বন্ধুকে পরামর্শ দেন, ‘একটু অ্যালাপেথিক খাও, যুগ পাল্টাচ্ছে। সায়েন্সের ওপর বিশ্বাস রাখতে হয়।’ একই আরজ আলী টানা পাঁচ বছর ধরে গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকে একজন চিকিৎসকের জন্য আবেদন পাঠাতে থাকেন, কিন্তু চিকিৎসক আর আসে না। যদিও শেষ পর্যন্ত আরজ আলীর পেয়ারের সরকারের গড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসক আসে এবং পুরোদস্তুর সেবাও দিতে থাকে।

কিন্তু প্রশ্ন, কোন্‌ সরকারের ওপর এতো আস্থার কথা বলছেন আরজ? যে সরকারের কাছে তিনি পাঁচ বছর ধরে চিকিৎসক চেয়েছেন, চিকিৎসক পাননি—সেই সরকার? নাকি পাঁচ বছরের ব্যবধানে রাষ্ট্রে নতুন যে সরকার এসে বন্ধ হওয়া ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’ চালু করেছে—সেই সরকার? তার মানে পাঁচ বছর আগের সরকার আর আজকের সরকারের মধ্যে আরজের ভাষায় পার্থক্য আছে। সেই পার্থক্যের সন্ধান না করে, আবারও একই প্রশ্ন করছি, আসলেই কি এই সরকার আর সেই সরকারে খুব বেশি পার্থক্য আছে?  

অবশ্য এ পরিবর্তন আরজ দেখতেই পারেন। কারণ দীর্ঘদিনের হোমিও চিকিৎসক আরজ যখন অ্যালোপ্যাথি খাওয়ার পরামর্শ দেন, তখন হোমিও-জার্মানি-মার্কস নিয়ে তার অবস্থানের ইঙ্গিত পরিষ্কার হয়। এটা খুবই পুরনো পন্থা—হোমিও দিয়ে মার্কসকে, তার শাস্ত্রকে অচল বলে প্রমাণ করা। নব্য উদারতান্ত্রিক ধারার পথে এগিয়ে যাওয়া কোনো দেশের উঠতি পরিচালকের কথায় এর প্রভাব না থাকলে চলে!

কিন্তু মার্কস কি অচল হন? আরজ যেভাবে বলেন, সায়েন্সের ওপর আস্থা রাখার কথা, তার মানে উল্টোভাবে অনাস্থা প্রকাশ পায় ‘অবৈজ্ঞানিক’ হোমিওপ্যাথি-মার্কসবাদ নিয়ে। অথচ মানব উন্নয়ন সূচকে, মার্কসের সবচেয়ে বড়ো সমালোচক যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কিন্তু পঞ্চম। আর অসমতার ভিত্তিতে যখন এই অবস্থান নির্ণয় করা হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আরো ২৩ ধাপ পিছনে চলে যায়। তখন মহামান্য যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান গ্রিস ও স্লোভাকিয়ার মতো দেশের পিছনে পড়ে। সমতার বিরুদ্ধে গিয়ে অসমতার যে সাম্রাজ্য যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করেছে, সেটা এখন প্রতিদিন সমতার ভূত হয়ে দেখা দিচ্ছে।

কলম্বিয়ান কমিউনিস্ট নেতা প্যাট্রিস লুমুম্বা’র মৃত্যুর পর দিল্লির এক শোকসভায় জওহরলাল নেহেরু বক্তৃতা করেছিলেন। সেই ৬০ দশকের গোড়াতে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার চেহারা তখন অন্যরকম ছিলো। রীতিমতো তাজা আত্মপ্রত্যয়ের সুর গলায় নিয়ে নেহেরু সেদিন বলেছিলেন, ‘A dead Lumumba is infinitely more powerful than a live Lumumba.

মুরাদের অবশ্য এ কথা মনে রাখার কোনো কারণ নেই।

৬.

আন্দোলন আর বিপ্লব এক জিনিস নয়। বিপ্লবে গুণগত পরিবর্তন লাগে। বিপ্লব জিনিসটা রিলে রেসের মতো; একজন কিছু দূর এগিয়ে আরেকজনের হাতে তুলে দেয়, সে আবার এগিয়ে নিয়ে যায়। তবে পিছানোর ইতিহাস যে একেবারেই নেই, তা নয়। তার পরও মূলধারার ইতিহাস এগিয়ে যাওয়ার। বৃহন্নলায় ‘বিপ্লবে’র সেই রিলে রেসের মশাল অপঘাতে মৃত্যুর পর আরজ দিয়ে যান কমিউনিটি ক্লিনিকের চিকিৎসক ডা. আবিরের হাতে। তরুণ চিকিৎসক আবির সমাজ সচেতন, একই সঙ্গে রাষ্ট্রেরও প্রতিনিধি। সেটাই হয়তো নির্মাতা মুরাদেরও দুর্বলতার জায়গা।

সাধারণত বিপ্লবীরা নির্মোহ হয়, তাদের মোহ কেবলই বিপ্লবে। তবে এর মধ্যে ঘরে-বাইরের ‘লুম্পেন’ স্বদেশি নেতা সন্দ্বীপও আছে, সঙ্গে বিমলাও। অবশ্য সন্দ্বীপের পুরোটা নেননি আবির। তিনি প্রকৃতই চেয়েছেন সমাজের পরিবর্তন, অর্থলিপ্সাও সেখানে অনুপস্থিত। কিন্তু বিপ্লবীর জন্য নৈতিক দৃঢ়তা তো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে এম এন রায়কে স্মরণ না করে পারছি না, নৈতিকতা নিয়ে তার অবস্থান খুব পরিষ্কার,

নীতিনৈতিকতা সংক্রান্ত বিচারবুদ্ধির সক্ষমতা যদি খোদ মানুষের মধ্যে অন্তর্জাত অবস্থায় না থাকে, তাহলে স্বাধীনতার মৌলিক তাড়নার পরিপূরণ হতে পারবে না। কেননা মানুষকে তাহলে অবশ্য-অবশ্যই কতিপয় নিয়মকানুন অথবা রীতির কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে হবে, যেসব নিয়মরীতি নানান বহিরাগত এজেন্সি তার জন্য বিছিয়ে রেখেছে।

তাই বিপ্লবে নীতিনৈতিকতা নিয়ে যদি ব্যক্তির অন্তর্জাত কোনো অবস্থান না থাকে তাহলে যেকোনো মতাদর্শের বিপ্লবই সাধারণত দাঁড়ায় না, এম এন রায়ের ভাষায় এজেন্সির জালে আটকা পড়ে।

বৃহন্নলার বেশিরভাগ চরিত্রের মতো আবিরেরও নৈতিক দৃঢ়তা নেই বললেই চলে। তাই তাকে বাইরের এজেন্সির বিছিয়ে রাখা জালে পা দিতে হয়। কাঠমিস্ত্রি তুলসীর বউ দুর্গা; চটপটে, সুন্দর, বুদ্ধিদীপ্ত তবে একটু চাহিদাসম্পন্ন; অবশ্য এটাকে অন্য অর্থে লোভী বললেও ভুল হবে না। কারণ তুলসী না চাইলেও টাকার জন্য বিষ খাইয়ে ছাগল মেরে ফেলার কূটচালে দুর্গা অতি আগ্রহী। কিংবা শাশুড়ি আর ছাগলের জন্য সরকারের টাকা পাওয়ার কথা শুনে তার চোখ চিকচিক করে ওঠে। সেই দুর্গার সঙ্গে সাধারণ সম্পর্কের বাইরে একটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন আবির। সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, চিকিৎসার নামে নিয়মিত দুর্গা যায় আবিরের কাছে। আবিরও রাতে দুর্গার সঙ্গে দেখা করে। এ নিয়ে দুর্গা-তুলসীর দাম্পত্য জীবনেও সমস্যা দেখা দেয়। যদিও পরে বোঝা যায়, রায়ের ভাষায় ‘বাইরের এজেন্সি’ গৌড় কাকার পরামর্শেই আবিরকে হত্যা করতে দুর্গা প্রেমের অভিনয় করেছে আবিরের সঙ্গে। তার পরও শেষ পর্যন্ত নিজেকে উতরাতে পারেন না মুরাদ। সেখানে তিনি নিজেই নতুন সমস্যায় পড়ে যান, কারণ তখন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে নারীকে সেই গতানুগতিক ভোগ্যপণ্য হিসেবে উপস্থাপনের।

অন্যদিকে দুর্গা-আবির সম্পর্ককে তিনি যদি সাধারণ মানবিক প্রেমের সম্পর্ক হিসেবে দেখাতে চান, সেখানেও প্রশ্ন ওঠে; কারণ দুর্গার শারীরিক সৌন্দর্য ছাড়া কী এমন বৈশিষ্ট্য আছে যা দেখে উচ্চশিক্ষিত-সচেতন-বিপ্লবী আবির তার প্রতি আকর্ষিত হতে পারেন! দুর্গার সঙ্গে সম্পর্কের প্রারম্ভিকে চরিত্রের গভীরতা অনুযায়ী কোনো দৃঢ়তাই দেখাতে পারেননি আবির। চিকিৎসার নামে ক্লিনিকে এসে দু’দিনের মন ভোলানো হাসি, এক বাটি নাড়ু দিয়ে যে ব্যক্তিকে কাত করে ফেলা যায়, তাকে দিয়ে আর যাই হোক বিপ্লব হবে না। মুরাদ অবশ্য তাকে দিয়েও শেষ পর্যন্ত বিপ্লব করিয়ে ডাক্তারির সঙ্গে সঙ্গে মাস্টারিও করিয়েছেন। সঙ্গে মসলা হিসেবে রেখেছেন তুমি ‘অপূর্ব সুন্দর’ জাতীয় সংলাপ, অপ্রয়োজনে নায়িকাকে বৃষ্টিতে ভেজানো, মেরুন রঙের ব্লাউজে ভেজা বুক-পিঠ।

এতো পরিবর্তনের কথা বলা মুরাদের কি এগুলো দেখালে চলে!

৭.

বৃহন্নলার ন্যারেটিভের আদি পর্বে অসাম্প্রদায়িক বাংলাকে দেখি আমরা। পর পর শটে অসাম্প্রদায়িক বাংলার স্টাবলিশমেন্টে মুরাদের যেনো চেষ্টার কমতি নেই। তাই খুব গতানুগতিকভাবেই আজানের পাশাপাশি তাকে শঙ্খের ধ্বনি শোনাতে হয়। কীর্তনের পাশাপাশি দেখাতে হয় পুথিপাঠ। মন্দির কমিটির সভাপতির মুখে শোনা যায়, ‘আজানের পরে আরতি করবা, একসাতে থাকতি হলি এগুলা মানতি হয়।’ কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে মুরাদের সেই সম্পর্কের উপস্থাপনায় টান পড়ে। অবশ্য অল্প সময়ের মধ্যেই টান পড়া সেই সম্পর্ক ঠিক করার দায়িত্ব নিয়ে হাজির হয় রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। অথচ

মানবজাতির কুড়ি লক্ষ বছরের বিকাশধারায় কিন্তু বলপ্রয়োগ ও প্রতিশোধ-পরায়ণতার এই ভাষা কিংবা নিকেশ ও নির্মূলের এই ভাষা সমাজের ভাষা ছিল না। ভাষাটা ছিল সংহতি, সহযোগিতা, সৃজনশীলতা, বোঝাপড়া, সমঝোতা ও লেনদেনের ভাষা। এখনও তার অবশিষ্ট নিশানা-চিহ্ন-ঈঙ্গিত আছে গানে-কবিতায়, সাহিত্যে ও প্রকৃতিতে-মূলধারার ও আদিবাসীদের সমাজে, সংগঠনে ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে।

তার মানে সঙ্কট সৃষ্টি হলেই নিজেদের বোঝাপড়ার তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্র এতো সহজে হাজির থাকেনি, অন্য কথায় দরকার পড়েনি।

বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে কৌশলে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ শুধু যে ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তা বিকাশের মতাদর্শ তা নয়, সামাজিক ন্যায়বিচার ও ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা ঐতিহাসিকভাবে এর মধ্যে প্রোথিত’ আছে—এই মতাদর্শের বুলি আউড়িয়ে তার অবস্থানকে প্রতিদিন পোক্ত করেছে। আর এই যুক্তিকে সামনে রেখেই ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে একটা নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়ে সবাইকে এক ছায়াতলে এনেছিলো আওয়ামী লীগ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রের চরিত্রে তা ধরে রাখতে পারেনি তারা। কারণ রাষ্ট্রের নিজের বল প্রয়োগের যে ভয়ঙ্কর ক্ষমতা, সেখানে সামাজিক ন্যায়বিচার ও ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি নিয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয়; এগুলোকে এদিক-ওদিক ব্যবহার করে রাষ্ট্র নিজেই টিকে থাকে। এর খেসারত অবশ্য ১৯৭৫-এর পর টানা ১৫ বছর পুরো জাতিকে দিতে হয়েছিলো।

দীর্ঘ এই সময়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রের কথা বলে যা হয়েছে সেটাও সবার জানা। তবে সেই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতির নানাধরনের পালাবদলের মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে পাঁচ বছর পূর্ণ করে। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ একটি ‘নির্বাচনে’র মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় আসে তারা। অবশ্য এতদিনে প্রধান দুই দল রাষ্ট্রের মদদে বাঙালি ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের নামে সামাজিক ন্যায়বিচার ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে চিপে আখের ছোবড়া বানিয়ে ফেলেছে। তবে এই ছোবড়াই এখন বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে।

নির্মাতা মুরাদ সেই ছোবড়া বিক্রির দায়িত্ব নিয়েছেন বৃহন্নলায়। বিপরীতে তিনি ভুলে গেছেন গান্ধীজির সেই বাণী—‘সহিংসতার ঘনীভূত ও সুসংহত রূপের প্রতিনিধিত্ব করে রাষ্ট্র। ব্যক্তির আত্মা থাকে, কিন্তু রাষ্ট্র যেহেতু আত্মাবিহীন একটা মেশিন, সেহেতু তা কখনোই সহিংসতা থেকে মুক্ত হতে পারবে না—কেননা এর খোদ অস্তিত্বটাই তো সহিংসতার কাছে ঋণী।’

৮.

শেষ শটে দেখা যায়, সরকারের ডিক্রি জারি করা সেই খাসজমির সেই বটগাছের নীচে ক্লোজ-আপে বৈদ্যুতিক বাতি, ব্যাকগ্রাউন্ডে ডা. আবির নৈশস্কুলে বয়স্কদের পড়াচ্ছেন। ইমেজের খেলা বোঝা বড়ো দায়! অর্থবিজ্ঞানে কোনো কিছুই নির্ধারিত থাকে না, বলা হয় সবকিছুই আরোপিত। আরোপণের এই ক্ষমতা অনেককে ক্ষমতাবান করে তোলে। গত বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বেহাল অবস্থার কথা দেশবাসীর অজানা নয়; একই সঙ্গে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সফলতা’ও।

আওয়ামী লীগ সবসময় সাংস্কৃতিক প্রকাশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পেরেছে—এটা তার সবচেয়ে বড়ো ক্ষমতা। তাই শিল্পমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা তার জন্য সহজ হয়। আর সেটা যদি হয় সরকারি অনুদানের চলচ্চিত্র, তাহলে তো কথাই নেই। তাই কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে অজপাড়াগাঁয়ে নতুন আসা বিজলিবাতি জ্বালিয়ে মুরাদকে তার চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়েও প্রমাণ করতে হয় সরকারের সফলতার কথা। আর এখানেই হয়তো নির্মাতা মুরাদের ‘অসহায়ত্ব’। তার শিল্প সৃষ্টির প্রসব বেদনা থামাতে তাকে শেষ পর্যন্ত সরকারের কাছে যেতে হয়েছে। সরকার তার বেদনা উপশম করেছে ঠিকই, সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে বড়ো বোঝা।

মুরাদও নিশ্চয়ই সে বোঝা টেনে আনন্দই পেয়েছেন।

৯.

পোশাক পরিকল্পনা চলচ্চিত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদিও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে পোশাক পরিকল্পনা বলে কোনো শাখা এখনো দাঁড়ায়নি। গ্রামীণ বধূর চেক শাড়ি, ঘটি হাতা ব্লাউজ থাকে ঠিকই কিন্তু সেই শাড়ি সবসময় শুটিংয়ের আগে কেনা হয়। দেখে মনে হয়, এই বধূরা সবসময় নতুন শাড়িই পরে। বৃহন্নলাতে দুর্গার পোশাক এর ব্যতিক্রম নয়, সঙ্গে প্রপস্‌ হিসেবে কাঠমিস্ত্রির বউয়ের গলায় দেখা যায় সোনার লম্বা গুটি চেইন। হিন্দু বধূর গলায় চেইন থাকতেই পারে, কিন্তু সোনার দামের এই বাজারে সেই চেইন কী হবে তা নিয়ে পরিমিতি বোধ থাকা জরুরি।

বৃষ্টির যে দৃশ্য মুরাদ দেখান, সেখানে একটু ভালোভাবে লক্ষ করলে শুভঙ্করের ফাঁকিটা ধরা যায়। বৃষ্টির দৃশ্যের ব্যাকগ্রাউন্ডে যে স্কুল মাঠ, সেখানে স্পষ্ট বোঝা যায়—বৃষ্টি নেই। নির্দিষ্ট জায়গায় কৃত্রিম বৃষ্টি তৈরির কৌশল পুরনো কিন্তু সেক্ষেত্রে সচেতনতা জরুরি।

তবে দু-একটি শটে মুরাদের মুন্সিয়ানা চোখে পড়ে। দুর্গা-আবির যখন রাতে নদীতে নৌকায় বসে কথা বলে তখন এক অসাধারণ মায়াবি দৃশ্যের অবতারণা হয়। একই সঙ্গে দেবতা-বটগাছে হিন্দুদের লাগানো লাল-নীল ফিতা ছিঁড়ে ফেলার দৃশ্যে রাতের অন্ধকারে কেবল সাদা সাদা বস্তুর উপস্থিতি একটা পরাবাস্তব ইমেজ তৈরি করে। রাতের দৃশ্য ধারণে মুরাদের দক্ষতা ফুটে ওঠে।   

১০.

একজন লেখক, যাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাহিত্যবিষয়ক অবস্থান রয়েছে, তাঁর উচিত নিজস্ব শক্তি অর্থাৎ লিখিত শব্দের শক্তি দিয়ে চালিত হওয়া। পুরস্কৃত হওয়ার ফলে লেখকের ওপর (প্রাতিষ্ঠানিক) চাপ সৃষ্টি হয়, যা কখনোই কাম্য নয়। আমার নাম জঁ পল সার্ত্র, অথচ যদি লেখা হয় জঁ পল সার্ত্র, নোবেল বিজয়ী, তাহলে দুটো বিষয় এক হবে না।

১৯৬৪ সালের ২২ অক্টোবর ফ্রান্সের ‘ল্য মঁদ’ পত্রিকায় সাহিত্যে পাওয়া নোবেল প্রত্যাখান করে এক নিবন্ধে কথাগুলো লেখেন বিখ্যাত দার্শনিক-কথাসাহিত্যিক জঁ পল সার্ত্র। সার্ত্রের এ কথা নিয়ে বিতর্ক আছে—এটা যেমন ঠিক, একইভাবে পুরস্কারের যে চাপ আছে সেটাও ঠিক। বেশিরভাগ সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য সে চাপ সহ্য করা একটু কঠিনই।

জীবনের প্রথম চলচ্চিত্রেই আটটি শাখায় জাতীয় পুরস্কার (চন্দ্রগ্রহণ সেরা চলচ্চিত্র, সংলাপ, চিত্রনাট্য, পরিচালনা, সহ-অভিনেতা (দুটি), খলনায়ক ও সঙ্গীত পরিচালক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়) আর দ্বিতীয়টিতে সরকারের অনুদান—যেকোনো পরিচালকের জন্যই বড়ো প্রাপ্তি—মুরাদের ঝুড়িতে তা-ই আছে। এটা কেউ স্বীকার করুক আর না-ই করুক, মুরাদ এই চাপ অস্বীকার করতে পারেন না। একদিকে জাতীয় পুরস্কার, আরেক দিকে মহামূল্যবান ‘সরকারি অনুদান’—পুরস্কারের চাপ মুরাদকে নাস্তানাবুদ করে দেয়। নিরুপায় শিল্পী-মুরাদ জমি বিক্রি করেন, গাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন—শেষ পর্যন্ত পুঁজিপতির মোড়কে থাকা রাষ্ট্র-নির্মাতাদের আর্থিক সহায়তা নেন। ফলে কাহিনির কেবল মোড় ঘোরে, কেবলই ঘোরে, ঘোরে ঘোরে আর ঘোরে। কাহিনি যতো ঘোরে শিল্পী-মুরাদ, নির্মাতা-মুরাদের বুজরুকি ততো বাড়ে।

আর শিল্পী বুজরুক হলে আর যাই হোক শিল্পের জন্ম হয় না।

 

লেখক : কাজী মামুন হায়দার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ান।

kmhaiderru@yahoo.com 

 

তথ্যসূত্র

১. ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোথাও কোথাও স্থানীয় লোকজন ক্লিনিকগুলো টিকিয়ে রেখেছিলো, কোথাও আবার বেসরকারি সংস্থা সাধারণ মানুষকে সহযোগিতা করেছে। পরে ২০১০ সালে নতুন একটি প্রকল্পের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করে তৎকালীন মহাজোট সরকার। এতে সহযোগিতা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

২. স্টিগলিৎজ, জোসেফ ই; ‘এ এক অসহায়ত্বের যুগ’; প্রথম আলো, ১৫ অক্টোবর ২০১৪।  

৩. ভট্টাচার্য, সৌরীন; ‘মার্কস ও মার্কসবাদ বিষয়ে একটি সন্দর্ভ’; কালি কলম; সম্পাদনা : আবুল হাসনাত; বর্ষ ১১, সংখ্যা ৯, অক্টোবর ২০১৪, ঢাকা।

৪. এম এন রায়, উদ্ধৃত; নিউটন, সেলিম রেজা (২০১৩ : ৮১); নয়া মানবতাবাদ নৈরাজ্য : এম. এন. রায়ের মুক্তিপরায়নতা প্রসঙ্গে; আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।

৫. http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/22289

৬. রহমান, সুমন (২০১১ : ৬২); ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মধ্যবিত্তের মাদ্রাসা’; কানার হাটবাজার; দুয়েন্দে, ঢাকা।

৭. মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, উদ্ধৃত; নিউটন, সেলিম রেজা (২০১৩ : ৫); নয়া মানবতাবাদ নৈরাজ্য : এম. এন. রায়ের মুক্তিপরায়নতা প্রসঙ্গে; আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।

৮. জঁ পল সার্ত্র, উদ্ধৃত; ফেরদৌস, হাসান; ‘নোবেল প্রত্যাখানের পঞ্চাশ বছর’; প্রথম আলোর শুক্রবারের ক্রোড়পত্র  ‘শিল্পসাহিত্য’, ৩১ অক্টোবর ২০১৪।


বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের অষ্টম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন